Saved articles

You have not yet added any article to your bookmarks!

Browse articles
Newsletter image

Subscribe to the Newsletter

Join 10k+ people to get notified about new posts, news and tips.

Do not worry we don't spam!

GDPR Compliance

We use cookies to ensure you get the best experience on our website. By continuing to use our site, you accept our use of cookies, Privacy Policy, and Terms of Service.

নদিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস: বাংলার বিবর্তনের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়

নদিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস এক সমৃদ্ধ, জটিল ও বহুস্তরীয় ধারা। প্রাচীন রাঢ়ভূমির অন্তর্গত এই অঞ্চল, যার এক সময়ের নাম ছিল নবদ্বীপ, বাংলার ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য পর্ব হয়ে আছে। সপ্তম শতাব্দীতে শশাঙ্কের হাত ধরে নদিয়ার রাজনৈতিক পরিচয়ের সূচনা। কর্ণসুবর্ণ ছিল তাঁর রাজধানী, কিন্তু নদিয়া ছিল তার প্রভাবের অন্তর্গত একটি প্রাণবন্ত কেন্দ্র। পাল ও সেন রাজবংশের আমলে এই অঞ্চল হয়ে ওঠে বৌদ্ধ ও হিন্দু বিদ্যাচর্চার এক বিশিষ্ট আসন, যেখানে যুক্তিবিদ্যা ও ন্যায়-দর্শনের আলোয় উদ্ভাসিত হন রঘুনাথ শিরোমণির মতো পণ্ডিতেরা। নবদ্বীপ তখন ছিল “বাংলার অক্সফোর্ড”, যেখানে দর্শনচর্চা আর বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক হয়ে উঠেছিল এক ঐতিহ্য। 

তারপর এক বিরাট পালাবদলের সূচনা ঘটে মধ্যযুগে, যখন নদিয়া হয়ে ওঠে ভক্তিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম, কীর্তন আন্দোলন, বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার—এইসব এক নতুন সামাজিক-ধর্মীয় চেতনার জন্ম দেয়। নদিয়া তখন আর শুধু পণ্ডিতদের তীর্থ নয়, সাধারণ মানুষের আত্মারও তীর্থভূমি হয়ে ওঠে। নদিয়ার মাটি তখন ভক্তির, বিপ্লবের, ও বৈষ্ণব ঐতিহ্যের স্পন্দনে কাঁপছিল।

মুঘল শাসনে নদিয়া বাংলা সুবার অন্তর্গত এক গুরুত্বপূর্ন অংশ হয়ে ওঠে। বাণিজ্য ও কৃষির সঙ্গে সঙ্গে তাঁতশিল্পের বিকাশ হয়, বিশেষত শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি অঞ্চলে। ভাগীরথী নদী হয়ে ওঠে নদিয়ার অর্থনীতির প্রধান ধমনী। এই সময় কৃষ্ণনগরের রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে, যারা মুঘলদের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসনের কিছু সুবিধা লাভ করে এবং পরে ব্রিটিশদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এই রাজনৈতিক কৌশল নদিয়ার ভবিষ্যত রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলে। 


মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ( ছবি পরিমার্জিত) 

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর নদিয়ার রাজনৈতিক অবস্থান আমূল বদলে যায়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে নদিয়া হয়ে ওঠে এক প্রশাসনিক ইউনিট। কৃষি, তাঁতশিল্প এবং শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন হলেও, রাজনৈতিক দিক থেকে এটি হয়ে পড়ে ব্রিটিশদের অনুগত এলাকা। তবু, নদিয়ার সাংস্কৃতিক জাগরণ থেমে থাকেনি। শান্তিপুরে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে সাহিত্য ও শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখে। কৃষ্ণনগর রাজবংশ ব্রিটিশদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রভাব ধরে রাখে, কিন্তু সেই প্রভাব আর নিঃস্বার্থ ছিল না।

স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে নদিয়া নবজাগরণের ধ্বনি তোলে। স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ ও শান্তিপুর হয়ে ওঠে প্রতিরোধের কেন্দ্র। ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলনে নদিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণি, শিক্ষিত যুবক ও সংস্কারপন্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। জাতীয়তাবাদের বীজ নদিয়ার সমাজে রোপিত হয়, যা স্বাধীনতার স্বাদ পেতে সাহায্য করে। সেই সংগ্রামের পেছনে ছিল শুধু রাজনীতি নয়, ছিল আত্মপরিচয়ের এক অন্বেষণ।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পরে নদিয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের অংশ। দেশভাগ নদিয়াকে ছিন্ন করে দেয়; তার পূর্ব অংশ বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় চলে যায়। এক নতুন ভূগোল, এক নতুন প্রশাসন গড়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে কংগ্রেসের আধিপত্য থাকলেও, ১৯৭০-এর দশকে বামফ্রন্ট নদিয়ায় রাজনৈতিক ভিত গড়ে তোলে। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বামফ্রন্টের শাসনে ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও কৃষি উন্নয়ন নদিয়ার সমাজে স্থায়ী ছাপ ফেলে। এই সময় নদিয়ার রাজনীতি হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষ, কৃষক ও শ্রমজীবীদের অধিকারের কণ্ঠস্বর।

২০১১ সালে পালাবদল ঘটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসে এবং নদিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যেতে থাকে। শহরাঞ্চলে—বিশেষত কৃষ্ণনগর ও রানাঘাটে—তৃণমূলের প্রভাব দৃঢ় হয়। তৃণমূল কংগ্রেস নদিয়ায় নতুন রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, এবং শিক্ষায় জোর দেয়। তবে ২০১৪ সাল থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি নদিয়ায় তাদের রাজনৈতিক শিকড় গাঁথার চেষ্টা করে, যা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে স্পষ্ট হয়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ে, বিভাজনও তৈরি হয়।

২০২২ সালে নদিয়ার প্রশাসনিক মানচিত্র আবার বদলে যায়—রানাঘাটকে পৃথক করে নতুন জেলা ঘোষণা করা হয়। কৃষ্ণনগর, তেহট্টা, কালীগঞ্জ, ও রানাঘাট হয়ে ওঠে জেলার চারটি মহকুমা। জেলা পরিষদ ও ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা স্থানীয় রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা নেয়। রাজনীতির পরিসর এখন আর কেবল দলীয় আনুগত্যে সীমাবদ্ধ নয়—ভূমি, কৃষি, অভিবাসন ও সীমান্ত সমস্যা রাজনীতির নতুন মুখ হয়ে দাঁড়ায়।

নদিয়া আজও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, সচেতন ও চঞ্চল। তৃণমূলের আধিপত্য থাকলেও, বিজেপি ও সিপিআই(এম) তাদের প্রভাব বাড়াতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নদিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন এক বহুরৈখিক মানচিত্র—যেখানে ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, ধর্মীয় স্নায়ু, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং সীমান্ত রাজনীতি—সব একসঙ্গে রাজনীতিকে নির্ধারণ করে।

নদিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা এক অক্ষয় রূপান্তরের দলিল। এই জেলা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি আয়না—যেখানে প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিটি পরিবর্তন, প্রতিটি প্রতিরোধ এক বিস্তৃত সময়ের ভাষ্য হয়ে থেকে গেছে। নদিয়া কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, এটি একটি রাজনৈতিক চেতনার নাম—যার ইতিহাস অতীতকে ধারণ করে, বর্তমানকে ব্যাখ্যা করে, আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে।

Related to this topic: