Saved articles

You have not yet added any article to your bookmarks!

Browse articles
Newsletter image

Subscribe to the Newsletter

Join 10k+ people to get notified about new posts, news and tips.

Do not worry we don't spam!

GDPR Compliance

We use cookies to ensure you get the best experience on our website. By continuing to use our site, you accept our use of cookies, Privacy Policy, and Terms of Service.

আইকনোগ্রাফি থেকে অলংকার: এক নজরে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা হিন্দু ধর্মীয় শিল্পকলার এক অতুলনীয় নিদর্শন, যা দেবী দুর্গার একটি শক্তিশালী রূপ হিসেবে চিত্রিত হয়। এই প্রতিমা মূলত মাটির তৈরি, এবং এর নির্মাণ প্রক্রিয়া কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের গৌরব বহন করে। প্রতিমার শৈল্পিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে আইকনোগ্রাফিক নিপুণতা, উপকরণ নির্বাচনের সূক্ষ্মতা, কারুকার্যের অভিনবত্ব এবং ভাস্কর্যগত মৌলিকতা একসঙ্গে মিলেমিশে এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে, যা শুধু ধর্মীয় আবহেই সীমাবদ্ধ নয়—বরং সামাজিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সত্তার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

জগদ্ধাত্রী প্রতিমার রূপায়ণ পুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রের বর্ণনার অনুসরণে গঠিত। দেবীকে এখানে সিংহবাহিনী রূপে চিত্রিত করা হয়, যেখানে তিনি সিংহের পিঠে বসে রয়েছেন এবং পাদদেশে রয়েছে ছিন্ন করীন্দ্রাসুরমুণ্ড—যা অহংকারের বিনাশের প্রতীক। তাঁর ত্রিনয়ন তাঁর সর্বজ্ঞতা এবং যোগিনীস্বরূপের দ্যোতক। দেবীর চার হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ বিরাজমান, প্রতিটি অস্ত্র একটি দার্শনিক তাৎপর্য বহন করে—পবিত্রতা, অশুভ শক্তির বিনাশ, জ্ঞান ও শক্তির প্রতীক। গলায় সাপের মতো যজ্ঞোপবীত এবং রক্তবর্ণ বস্ত্রের ব্যবহারে এই দেবীমূর্তি রজোগুণময়ী এক শক্তির অভিব্যক্তি হয়ে ওঠে। কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা এই প্রতিটি উপাদান অত্যন্ত নিখুঁত দক্ষতায় উপস্থাপন করেন, যা প্রতিমার দর্শনে একধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা এনে দেয়।

প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণগুলি স্থানীয় এবং প্রাকৃতিক, যেমন—মাটি, খড়, কাঠ ও রঙ। তবে ‘বুড়িমা’ প্রতিমার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সোনা-রূপার অলংকার ও বেনারসি জামদানি শাড়ি একে এক অনন্য স্থানে পৌঁছে দেয়। সাড়ে সাতশো ভরি সোনার গয়না ও থিম-ভিত্তিক সাজসজ্জা প্রতিমার শিল্পসৌন্দর্যকে রাজকীয় উচ্চতায় নিয়ে যায়। অলংকারে সূক্ষ্ম খোদাই, মুকুটে জটিল নকশা, চোখ-মুখের রেখাচিত্রে আবেগের ছায়াপাত—এসবই কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের অভূতপূর্ব দক্ষতার পরিচায়ক।

শুধু প্রতিমা নয়, তার চারপাশের পরিবেশও একান্ত শিল্পসুষমায় মণ্ডিত হয়। আলোকসজ্জা, প্যান্ডেলের নির্মাণশৈলী, পুষ্পসজ্জা—সব মিলিয়ে জগদ্ধাত্রী পূজা এক চাক্ষুষ শিল্প-উৎসবে পরিণত হয়। বিশেষভাবে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই পুজোর তিনটি প্রতিমা—বুড়িমা (চাষাপাড়া), ছোট মা (কাঠালপোতা) ও মেজো মা (কলেজ স্ট্রিট)—বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি প্রতিমার শৈল্পিক উপস্থাপন ভিন্ন, তবে তাদের সকলের মূলে একই ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য প্রবাহিত।

এই প্রতিমার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত নয়। সাহিত্যেও এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়—যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জগদ্ধাত্রী দেবীর চিত্র ‘ভারতমাতা’র সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। এতে শৈল্পিকতা এক জাতীয়তাবাদী মাত্রাও লাভ করে।

এইরূপ বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে যে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা কেবল ধর্মীয় ভাস্কর্য নয়, এটি এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্মারক। এর প্রতিটি রেখা, রঙ, অলংকার ও ভঙ্গিমায় শিল্পের যে গভীরতা ও ঐতিহ্যের যে ধারা প্রবাহিত, তা বাংলার মৃৎশিল্প ইতিহাসে কৃষ্ণনগরকে একটি গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

Related to this topic: