Saved articles

You have not yet added any article to your bookmarks!

Browse articles
Newsletter image

Subscribe to the Newsletter

Join 10k+ people to get notified about new posts, news and tips.

Do not worry we don't spam!

GDPR Compliance

We use cookies to ensure you get the best experience on our website. By continuing to use our site, you accept our use of cookies, Privacy Policy, and Terms of Service.

শান্তিপুরের তোপখানা মসজিদ: প্রাচীন ঐতিহ্যের অমল ছায়ায় এক সাংস্কৃতিক নিবেদন

নদীয়ার হৃদয়স্থলে অবস্থিত শান্তিপুর যেন বাংলার এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক-পটচিত্র। এখানে তাঁতের টানে সুতো জড়ায় শুধু কাপড়ে নয়, ইতিহাসের শরীরেও; এখানে বৈষ্ণবের করতালে রাধা-কৃষ্ণের সঙ্গে ধ্বনিত হয় মুঘল স্থাপত্যের মিনার-ধ্বনি। এই শহরের বুকেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে তোপখানা মসজিদপ্রায় তিন শতাব্দী ধরে এক নিঃশব্দ অথচ বলিষ্ঠ ভাষ্যে বলে চলেছে শান্তিপুরের গৌরবময় অতীত, তার বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্ম-সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের কথা।

এই মসজিদ যেন আদতে এক  স্মারক যা গড়ে উঠেছে শুধু ইট-পাথরের ওপর নয় বরং সময়ের স্তরে স্তরে জমে ওঠা ইতিহাসের ওপর। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে যখন গাজী  মহম্মদ ইয়ার খাঁ এই মসজিদ নির্মাণ করেন, তখন শান্তিপুর ছিল সামরিক গুরুত্বসম্পন্ন এক কৌশলক্ষেত্র। সেই তোপের গর্জনে মুখর তৎকালীন সমর প্রান্তরের এক প্রতিধ্বনি যেন আজও শোনা যায় এই স্থাপত্যে, যার জন্যেই তার নামতোপখানা মসজিদ।   

তবে এই স্থাপত্য নিছক কেবল অস্ত্রাগারের স্মৃতি বহন করে না। বরং তার গম্বুজে, তার  অষ্টমিনারে, তার অন্দরের নিপুণ নকশায় এক বহুমাত্রিক শিল্পরুচির অনুরণন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুঘল ঐশ্বর্যের সঙ্গে বাংলার আটচালা গৃহশৈলীর একটি নান্দনিক মেলবন্ধন দেখা যায় এখানে। যেন মসজিদের স্থপতি ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেনতাঁর নির্মাণশৈলীর ভাষাই যেন  আঞ্চলিক বাংলার সাথে মুঘল সমন্বয়ের ভাষ্য হয়ে ওঠে।  

এই মসজিদ শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের নামাজের স্থান নয়। এটি শান্তিপুরের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক সুদৃঢ় প্রতীক। এই শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে সহাবস্থানের বাতাস বহমান, তারই এক দৃশ্যমান নিদর্শন এই মসজিদ। ঈদের সকালে যখন মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢেউ ওঠে নামাজির ঢলে, তখন আশেপাশের গলিপথে হিন্দু প্রতিবেশীর মনও উদ্বেল হয়ে ওঠে সেই আনন্দধারায়, শিশুদের কলকাকলি মিশে যায়, প্রবীণদের চিরাচরিত কুশল বিনিময়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখগুলি। এ যেন এক ধর্মীয় নয়, মানবিক উৎসব  

অনামি হলেও এই মসজিদটির অবস্থান ও স্থাপত্য তাকে করে তুলেছে কালসন্ধানী পর্যটকের কাছে এক অনন্য আকর্ষণ। পাশেই শ্যামচাঁদ মন্দিরের গম্ভীরতা, অদ্বৈত প্রভুর স্মৃতি, বড় গোস্বামী বাড়ির সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক ইতিহাসসব মিলিয়ে এই শহর যেন এক বহুধ্বনির মেলবন্ধন। তোপখানা মসজিদ এই সমবায়ে যোগ করে মুঘল স্পর্শে রঞ্জিত এক ইতিহাসের ধ্বনি।    

তবে প্রশ্ন জাগেনদিয়া বাসীর বিস্মৃতির অতলেই থেকে যাবে এই মহান ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি  নাকি এক নবদিগন্তের সম্ভাবনার দিগ্দর্শনও হবে? রাজ্য সরকারের সংস্কার প্রকল্প এবং হেরিটেজ কমিশনের ৭৫ লক্ষ টাকার অনুদান নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। তবে তা যথেষ্ট নয় যদি না মসজিদটিকে একটি ইতিহাস-ভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরা যায়। শান্তিপুর-কলকাতা জলপথ চালু হলে এই স্থাপনাটিকে নিয়ে গড়ে উঠতে পারে একটি 'হেরিটেজ ট্রেইল'—যা পর্যটকের কৌতূহল এবং স্থানের গৌরব দুই-ই জাগ্রত করবে।

আজ যখন বিশ্ব রাজনীতি বিভাজনের মুখে, ধর্মের নামে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে ঘৃণার তীর, তখন  শান্তিপুরের তোপখানা মসজিদ যেন দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব প্রতিবাদী প্রতিমা হয়েযার প্রতিটি ইট আমাদের মনে করিয়ে দেয় সহাবস্থানের মানবিক সৌন্দর্য, ধর্মে-ধর্মে আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন,  এবং ইতিহাসের অন্তঃসারশূন্য ঘৃণার বিপরীতে বাঙালির চিরায়ত সম্প্রীতির ঐতিহ্য।   

এই মসজিদ তাই শুধুই একটি পুরাকীর্তি নয়, এটি এক সচল ঐতিহ্যযেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাপতন ঘটে এক অনুপম স্থাপত্যকীর্তিতে। শান্তিপুরের বুকজুড়ে তোপখানা মসজিদের দাঁড়িয়ে থাকা মানে ইতিহাসের দিকে পিছন ফিরে তাকানো নয়, বরং ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়াবিশ্বাস, সৌন্দর্য ও সমমর্মিতার পথে।


Related to this topic: