Saved articles

You have not yet added any article to your bookmarks!

Browse articles
Newsletter image

Subscribe to the Newsletter

Join 10k+ people to get notified about new posts, news and tips.

Do not worry we don't spam!

GDPR Compliance

We use cookies to ensure you get the best experience on our website. By continuing to use our site, you accept our use of cookies, Privacy Policy, and Terms of Service.

গ্রেস কটেজ: স্মৃতির আলো-অন্ধকারে নজরুল

কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়কের বুকে চাঁদের আলোর মতো জেগে আছে একটি ছোট্ট, অথচ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভবনগ্রেস কটেজ। বাইরে থেকে এটি হয়তো নিশ্চল এক সরকারি স্থাপনা, কিন্তু এর প্রতিটি ইট, প্রতিটি দেয়াল বুকে চেপে রেখেছে এক বিদ্রোহী কবির হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার নিঃশব্দ গল্প। এখানে বসেই কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে যেমন সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীতের অমর রত্নভাণ্ডার, তেমনই অন্যদিকে মুখোমুখি হয়েছিলেন জীবন ও মৃত্যুর বাস্তবতার সঙ্গে।     

১৯২৬ সালের এক বর্ষামুখর দিন, বন্ধু হেমন্ত সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে নজরুল কৃষ্ণনগরে এলেন। প্রথমে আশ্রয় নিলেন গোলাপট্টিতে, পরে চাঁদ সড়কের ধারে বৌবাজার এলাকায় ভাড়া নিলেন এই ব্রিটিশ আমলের কটেজটি। তখনই কি তিনি জানতেন, এই বাড়ি একদিন হয়ে উঠবে তাঁর জীবনের দুটি বিপরীত অনুভূতির স্মারকএকদিকে নবজীবনের গান, অন্যদিকে অন্তহীন শূন্যতার হাহাকার?

গ্রেস কটেজে এক উজ্জ্বল সকালেই জন্ম নিল তাঁর প্রিয় পুত্রঅরিন্দম খালিদ, যাকে স্নেহভরে ডাকতেন বুলবুল। সেই দিন যেন কবির হৃদয়ে নতুন প্রেরণার স্রোত এনে দিল। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে বুলবুলের মুখেভাতও অনুষ্ঠিত হলো এখানেই, হাসি আর গানময় ছিল সে সময়। যদিও নিয়তির নির্মম রসিকতায়, গ্রেস কটেজ ত্যাগ করার আরও কিছুকাল পরে মাত্র চার বছর বয়সেই সেই বুলবুলের ডানায় লাগল গুটিবসন্তের কালো ছোঁয়া। বুলবুল যেন উড়ে গেল দূর শূন্য আকাশে, নজরুলের বুকের ভেতর রয়ে গেল বেদনার এক অনন্ত ক্ষরণ। শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়”—এই গান যেন সেই শূন্যতার যন্ত্রণারই ভাষ্য।       

 বুলবুলের জন্ম যেমন কবিকে দিয়েছিল অনাবিল এক প্রেরনার প্রবাহ তেমনই গ্রেস কটেজে বসবাসকালে আরেক আঘাত নেমেছিল কবির জীবনে। এখানেই চিরশান্তির নিদ্রা গেলেন নজরুলের মা জাহেদা খাতুন, যাঁর সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল জটিলতা আর টানাপড়েনের । শৈশবে বিচ্ছিন্ন হওয়া মা-পুত্রের সম্পর্ক পুনরায় গড়ে উঠেছিল ভগ্নাংশে, কিন্তু মৃত্যুই শেষমেশ সেই পুনর্মিলনকে সম্পূর্ণ করেছিল। মায়ের মৃত্যু নজরুলকে ভেতর থেকে বিদীর্ণ করে দিল।  

তবে গ্রেস কটেজ শুধু যে কবির ব্যক্তিগত হাসিকান্নার স্মারক ছিল তা নয়, এই গৃহ সাক্ষী নজরুলের দানবীয় সৃজনশীলতারও। এখানে বসেই তিনি রচনা করলেন দারিদ্র’, ‘ফণী-মনসা’, ‘সাম্যবাদী’, এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম গজল। তাঁর কলমে ঝরল মৃত্যুক্ষুধাউপন্যাস, যেখানে জীবনের ক্ষুধা আর মৃত্যুর ছায়া পাশাপাশি হেঁটে চলল। এখানে তাঁর সৃষ্টির আকর ছিল বিদ্রোহের ডাক, সাম্যের স্বপ্ন, আর মানবতার দীপ্তি। কৃষ্ণনগরের বাতাসে মিশে গেল তাঁর ছন্দের তালে তালে প্রতিবাদের মুখর স্পন্দন।      

গ্রেস কটেজ, নির্মিত ১৯২৩-২৪ সালে, একসময় বিদ্যুৎকেন্দ্রের অংশ ছিল। পরে সে ইতিহাস মুছে গিয়ে সেখানে মুখর হয়ে উঠল নজরুলের কবিতা ও গানের সুর। ২০১২ সালে এই কটেজকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়এ যেন কবির প্রতি এক বিলম্বিত প্রণাম।   

কৃষ্ণনগর নিজেই এক ইতিহাসের শহররাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ধন-মান-কীর্তির স্মৃতিতে পূর্ণ। কিন্তু নজরুলের গ্রেস কটেজে বসবাস এই শহরের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। এখানে কবি ছিলেন কখনও প্রেমিক, কখনও পিতা, কখনও সন্তান, আবার কখনও বিদ্রোহী স্বপ্নদ্রষ্টা।

আজও যদি শীতল সন্ধ্যায় দাঁড়ানো যায় গ্রেস কটেজের সামনে, হয়তো শোনা যাবে হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা মৃদু সুর—“শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়। হয়তো অনুভব করা যাবে সেই অদৃশ্য করুণার তরঙ্গ, যা এক বিদ্রোহীর বুকে জন্ম দিয়েছিল সমানুপাতিক প্রেম আর বেদনার।

গ্রেস কটেজ নজরুলের জীবনের সংক্ষিপ্ত অথচ বহুবর্ণিল এক অধ্যায়। এখানে একসঙ্গে রয়েছে জন্ম ও মৃত্যু, সৃষ্টি ও ক্ষয়, প্রেম ও বেদনা। এই ক্ষুদ্র ভবনটি তাই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এক অন্যতম তীর্থস্থান হয়ে ওঠার দাবীদার, যেখানে এক বিদ্রোহী কবি তাঁর অগ্নিগর্ভ স্বপ্ন বুনেছিলেন, আর রেখে গিয়েছিলেন শোকগাথার এক অমোঘ ছায়া। গ্রেস কটেজ তাই শুধু এক বাড়ি নয়এটি এক বিদ্রোহী আত্মার স্মৃতির শেকড়, যেখান থেকে আজও বাংলা সাহিত্য জল পায়, প্রাণ পায়।  


Related to this topic: